আঞ্চলিক অস্থিরতা ও জ্বালানির ঘাটতিতে রিয়ালের দরপতন
ইরানে বন্ধ হচ্ছে জরুরি সেবা খাতসমূহ
রাজনীতি ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ০০:২৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
ইরানের বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত নবায়নযোগ্য জ্বালানিরও সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ইরানে একের পর এক জরুরি সেবা খাতগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে দেশটির লাখ লাখ বাসিন্দাকে। আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণে সম্প্রতি ইরানি মুদ্রা রিয়ালের ব্যাপক দরপতন ঘটে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ খাতসহ অন্যান্য জরুরি সেবাখাতগুলোর উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে।
বর্তমান শীত মৌসুমে ইরানের তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে আসে। এতে দেশটিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। এ অবস্থায় দেশটিতে জরুরি এ সেবাগুলোর ঘাটতি দেখা দেয়।
ফলে, চলতি সপ্তাহে রাজধানী তেহরানসহ ইরানের বড় বড় বেশ কয়েকটি প্রদেশে সরকারি দফতর, বিদ্যালয়, ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার।
জ্বালানির অভাবে বর্তমানে ১৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আজ বুধবার ইরানের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিমন্ত্রী আব্বাস আলিয়াবাদি এ কথা জানান।
সংসদীয় এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘পর্যাপ্ত জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো সমস্যা হতো না। কারণ, প্রয়োজনীয় কাজ শেষে এই শীত মৌসুমের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছিলো। জ্বালানি সরবরাহ বিষয়ে আমরা পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এ অবস্থায় বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত নবায়নযোগ্য জ্বালানিরও সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, পর্যাপ্ত বিদ্যুতের অভাবে বড় বড় কলকারখানাসহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মাঝারি থেকে ছোট ছোট দোকানপাটও বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে এর মালিকেরা।
একইসঙ্গে, ঘাটতি সামাল দিতে দেশজুড়ে বাসিন্দাদের ঘর গরম করার যন্ত্র হিটারের তাপমাত্রা গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমিয়ে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
এছাড়া, তেহরানের হাইওয়ে ও এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্যান্য এলাকার সড়কবাতিগুলোও বন্ধ রাখা হচ্ছে। ফলে, রাতে সড়কগুলোতে পুরো অন্ধকার নেমে আসছে। এতে, দেশের নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আশঙ্কা জানানো হয়েছে।
এদিকে, দেশজুড়ে এ বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য গত সোমবার জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেস্কিয়ান। এ শীতে সমস্যার সমাধান হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছি যেন আগামী বছর এ সমস্যায় পড়তে না হয়।’
তবে, এ সমস্যার শুরু মূলত গত মাসে, যখন প্রেসিডেন্ট দেশজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করেন। সস্তা জ্বালানি পুড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলে সে সময় সরকার থেকে দাবি করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখন বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে আনতে শুরু করে ইরানি সরকার।
সে সময় ইরানসহ দেশটির বড় বড় শহরগুলোতে ধোঁয়াশার পরিমাণ এতোটাই আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যায় যে স্যাটেলাইট থেকেও তা দৃশ্যমান হয়। এ অবস্থায় সেল ফোন ও ইন্টারনেটের টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশজুড়ে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে।
মূলত, প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতির কারণে মাজুত নামের একপ্রকার নিম্নমানের তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধ্য হয় বিভিন্ন কারখানা। কিন্তু, এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে বায়ু দূষণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়।
প্রতি বছর তেহরানে সংঘটিত মৃত্যুর ১৫ শতাংশ এ বায়ু দূষণের কারণে ঘটছে বলে চলতি মাসের প্রথম দিকে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলিরেজা রাইসি সতর্ক করেন। একইসঙ্গে, প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এর শিকার হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, সরকারি নানা অব্যবস্থাপনা ও ক্রমাগত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বহু বছর ধরেই ইরানে মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের সমস্যা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিদ্যমান এসব সমস্যা আরও প্রকট করবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় ইরানি মুদ্রা রিয়ালের ব্যাপক দরপতন দেশটিকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। মূলত, জ্বালানি সংকটের কারণে প্রায় প্রতিদিনই দরপতনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন রেকর্ড করছে রিয়াল।
আজ মার্কিন ডলারের বিপরীতে এ মুদ্রার মূল্য দাঁড়ায় ৭ লাখ ৭০ হাজার রিয়াল। গত বছর ইসরায়েলের ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা শুরুর পর থেকেই ইরানে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর, সম্প্রতি সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদী বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর অবস্থা সর্বোচ্চ খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ থাকার পরও বহু বছর ধরেই শীত মৌসুমে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের ঘাটতিতে পড়ছে ইরান। মূলত, দেশের জনগণের জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই এর কারণ বলে অনেক সরকারি কর্মকর্তা অভিযোগ করেন।
সূত্র : আল-জাজিরা।