লাইফস্টাইল

গুড প্যারেন্টিং

সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক গুণাবলি তৈরিতে বাবা-মায়ের করণীয়

সজীব সরকার

প্রকাশিত: ১৭:৪৭, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক গুণাবলি তৈরিতে বাবা-মায়ের করণীয়

বাবা-মায়ের সাথে ভালো বোঝাপড়া ও ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলে সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবেই ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। প্রতীকী ছবি।

শিশুদের মধ্যে ইতিবাচক নানা রকমের গুণ আশা করেন সব বাবা-মা। যেমন : সন্তানের মধ্যে শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা, সততা, উদারতা বা নৈতিকতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখতে চান সবাই। কিন্তু, অভিভাবকদের সবাই হয়তো সবসময় এটা বুঝতে পারেন না যে, শিশুরা কেবল বাবা-মায়ের আদেশ-উপদেশ থেকেই সবকিছু শেখে না; বাবা-মায়ের আচরণ অনুকরণের মাধ্যমেও তারা অনেককিছু শেখে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কাছে এমন অনেককিছুই আশা করেন, যা হয়তো তারা নিজেরাই পালন করেন না। ফলে, তাদের আদেশ-উপদেশের খুব বেশি প্রভাব শিশুদের আচরণের ওপর সবসময় পড়ে না।

বাবা-মা হয়তো তাদের সন্তানদের সবসময় সত্য বলতে পরামর্শ দিচ্ছেন; কিন্তু, সন্তানরা যদি দেখে যে বাবা-মা নিজেরাই নানা সময় অসত্য বা মিথ্যা বলছেন, তাহলে ওই সন্তানরা তাদের বাবা-মায়ের এমন নির্দেশ পালনে খুব বেশি আগ্রহী বা উৎসাহিত হবে না। বাবা-মা সন্তানদের বাজে কথা বা খারাপ আচরণ থেকে বিরত থাকতে বলে তারা নিজেরাই যদি নানাজনের সঙ্গে এমন আচরণ করতে থাকেন, তাহলে ওই শিশুরা বাবা-মায়ের কথাগুলোকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেবে - এমনটি আশা করা যায় না। শিশুসন্তানেরা যদি বাবা-মাকে সবসময় রাগ করতে বা গালমন্দ-পরনিন্দা-পরচর্চা করতে দেখে, তাহলে তারাও যে এমন আচরণ করতে শিখবে - এমন ঝুঁকি তো থাকবেই।

অর্থাৎ, বাবা-মা বা অভিভাবকদের উচিত হবে শিশুদের জন্য 'রোল মডেল' হয়ে ওঠা। তারা শিশুদের কাছে যেসব নৈতিক গুণাবলি আশা করেন বা যে ধরনের শৃঙ্খলা প্রত্যাশা করেন, ঠিক একই আচরণ শিশুদের সামনে তাদের নিজেদেরও করতে হবে। তাহলেই শিশুরা বড়দের আদেশ-উপদেশ-পরামর্শগুলোকে গুরুত্ব দিতে ও শ্রদ্ধা করতে শিখবে।

সন্তানের মধ্যে এমন ভালো গুণ তৈরি করতে চাইলে বাবা-মায়ের করণীয় কী - এখানে এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো।

শিশুরা বড়দের অনুকরণ ও অনুসরণ করে - বিষয়টি মনে রাখা : বড়দের আচরণ দেখে ছোটরা অনেককিছু শেখে। তাই, সন্তানের মধ্যে যে আচরণ প্রত্যাশা করেন, বাবা-মা হিসেবে তা নিজেদের মধ্যেও চর্চা করতে হবে। বাবা-মায়ের মধ্যে যদি কথা ও কাজের মিল না থাকে, তাহলে তাদের পরামর্শ মেনে চলতে সন্তানেরাও খুব বেশি উৎসাহী বোধ করে না। যেমন : কোনো সন্তান যদি দেখে যে তার বাবা-মা তার রেজাল্ট ভালো করার জন্য ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র যোগাড় করে এনেছেন, তাহলে ওই বাবা-মায়ের কোনো ভালো উপদেশ কি সে আসলে আমলে নেবে? সে নিজেও তখন পরীক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে আরো বড় অন্যায় বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে শিখবে।

রোল মডেল হয়ে ওঠা : বাবা-মাকে শিশুরা যেমন আচরণ করতে দেখে, তার অনেককিছুই তারা নিজেদের আচরণে অনুসরণ ও অনুকরণ করে। তাই, সন্তানদের মধ্যে যেমন আচরণ আশা করা হচ্ছে, এমন আচরণ যদি তাদের সামনে বাবা-মায়েরা করেন, এতে শিশুরাও একইরকম আচরণ করতে উৎসাহিত বোধ করবে। এভাবে বাবা-মাকে অনুসরণ ও অনুকরণের মধ্য দিয়েই সন্তানেরা ভালো অনেক আচরণ রপ্ত করে ফেলতে পারবে।

ছোট ছোট নিয়ম তৈরি করে দেওয়া এবং তা অনুসরণ করা : পরিবার ও সমাজে প্রত্যাশিত নিয়ম-কানুনগুলোকে ছোট ছোট করে শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে। সততা, নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলার মতো ধারণাগুলোকে শিশুদের উপযোগী করে ও সহজ করে বুঝিয়ে দিতে হবে। ছোট ছোট কাজের মধ্যে এ বিষয়গুলোকে সম্পৃক্ত করে শিশুদের এগুলোর চর্চার মধ্যে আনতে হবে। তাহলেই শিশুরা এসব সদগুণ চর্চার অভ্যাসের মধ্যে ঢুকে যাবে।

ঘরের নানা কাজ ও পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিশুদের যুক্ত করা : ঘরের ছোটখাট নানা কাজ - যা বাবা-মায়েরা করে থাকেন, সেগুলোতে শিশুদের যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন : ঘর গোছানো বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং রান্নার মতো কাজে সন্তানদের যুক্ত করা যেতে পারে। এতে শিশুরা কর্মঠ ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার দীক্ষা পায়। নিজের ও পরিবারের প্রতি যত্নশীল হতে শেখে। আর, পরিবারের নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শিশুদের উপেক্ষা না করে বরং তাদেরও সাথে নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এতে শিশুরা নিজেদের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ভাবার সুযোগ পায়। এর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, দায়িত্বশীলতা ও টিমওয়ার্কের মতো গুণাবলি গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়। সর্বোপরি, বাবা-মাসহ পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে শিশুদের আন্তরিকতা ও মুক্ত যোগাযোগের সুযোগ ও সম্ভাবনা বাড়ে। শিশুরা দায়িত্ব গ্রহণের মতো সাহস ও আত্মবিশ্বাস পায়।

সময়ের মূল্য বুঝতে শেখানো : শিশুদের সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করানো খুব জরুরি। সকালে সময়মতো ঘুম থেকে ওঠা ও রাতে ঘুমাতে যাওয়া, দিনের কাজগুলো সময়মতো করা, খেলাধুলা ও পড়াশোনার মতো কাজগুলো ঠিক সময়ে সেরে ফেলা - এসব বিষয় শিশুদের অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই তাদের মধ্যে সময়ানুবর্তিতার জ্ঞান বাড়বে এবং সময়ের মূল্য সম্বন্ধে উপলব্ধি বাড়বে।

শিশুদের ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া ও ক্ষেত্রবিশেষে পুরস্কৃত করা : শিশুরা যখন ভালো কোনো আচরণ করে বা ভালো কোনো কাজ করে, বাবা-মায়ের উচিত সেগুলোকে উপেক্ষা না করে এগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া। শিশুদের প্রশংসা করলে তারা এমন ইতিবাচক আচরণে আরো বেশি উৎসাহী হবে। বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে শিশুরা যদি বাড়তি ধৈর্য বা নৈতিকতার পরিচয় দেয়, তাহলে তাদের এমন কাজের প্রশংসার পাশাপাশি তাদের উপযোগী কোনো পুরস্কারের কথাও ভাবা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের বাড়তি সতর্কতা দরকার। বিষয়টি যেন এমন হয়ে না ওঠে যে কেবল প্রশংসা বা পুরস্কারের লোভেই শিশুরা ভালো আচরণ করবে অন্যথায় নয়।

গোপনীয়তা রক্ষা করা : শিশুরা বিশ্বাস করে বাবা অথবা মাকে কিছু বললে তা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করা যাবে না। এতে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের বিশ্বাস বা আস্থা যেমন নষ্ট হবে, তেমনি শিশুরাও হয়তো অন্যের বিশ্বাস রক্ষার গুরুত্ব সম্বন্ধে শিখবে না। শিশুদের জন্য বিব্রতকর হতে পারে, এমন অনেককিছুই বড়রা নিজেদের আড্ডায় বা আলাপে অন্যের সাথে শেয়ার করেন; এটিও ঠিক নয়। এতে শিশুরা বাবা-মায়ের ওপর আস্থা হারায়। এমন বিষয়গুলো শিশুরা গোপন রাখতে চাইলে বড়দের তা মেনে চলা উচিত।

শিশুদের ব্যক্তিগত সীমাকে শ্রদ্ধা করা : বড়দের মতো শিশুদেরও ব্যক্তিগত একটি সীমার (প্রাইভেসি) বোধ থাকে যেখানে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বড়দের প্রবেশ করা উচিত নয়। অন্যের প্রাইভেসিকে শ্রদ্ধা করার বিষয়টি শিশুরা এখান থেকেই শিখবে।
 
সন্তানের ওপর অতি-প্রত্যাশার চাপ তৈরি না করা : সব শিশুই একে অন্যের থেকে আলাদা। তাদের মেধা বা দক্ষতার ধরন ও প্রকাশ আলাদা। বাবা-মায়েদের এ বিষয়টি বুঝতে হবে। শিশুদের মেধার ধরন বা কীসে তাদের আগ্রহ- তা বোঝার চেষ্টা না করে তাদের ধারণ ক্ষমতার বাইরে গিয়ে অতি-প্রত্যাশার চাপ তৈরি করা ঠিক নয়। সন্তানের মেধার ধরন ও নানা বিষয়ে তাদের আগ্রহের মাত্রা বুঝে সে অনুযায়ী ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করে দিলে ক্রমেই তারা নানা বিষয়ে উন্নতি করতে পারবে। এর বিপরীতে নির্বিচার ও অতি-প্রত্যাশা বরং তাদের নানারকম ক্ষতিরই কারণ হবে।

অন্যের সাথে তুলনা না করা : নিজের সন্তানকে অন্যের সন্তান অর্থাৎ অন্য কোনো শিশুর সাথে তুলনা করা উচিত নয়। যেমন : ক্লাসের কেউ খুব ভালো রেজাল্ট করছে; তখন তার সাথে তুলনা দিয়ে 'ও পারে, তুমি কেন পারো না' - এমন তুলনা দেওয়া ঠিক না। এ ধরনের তুলনা করতে থাকলে শিশুদের নিজেদের ওপর থেকে বিশ্বাস বা আস্থা উঠে যেতে পারে। বাবা-মায়ের সাথেও সম্পর্কের মিষ্টতা নষ্ট হতে পারে। এমন না করে তাকে আরো ভালো করার জন্য বাড়তি উৎসাহ দেওয়া ও যত্ন করা উচিত।

নিজের যত্ন নিতে শেখানো : শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য নিজের প্রতি যত্নশীল হতে শেখার গুরুত্ব অনেক। যে নিজের প্রতি যত্নশীল হতে শেখে না, সে অন্য ব্যক্তি বা কোনো কাজের প্রতি খুব যে যত্নশীল হতে শিখবে - এমনটি হওয়া খুব বিরল ব্যাপার। এজন্য শৈশবেই শিশুদের মধ্যে নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া ও নিজেকে ভালোবাসতে শেখানো জরুরি।

সহানুভূতির পাশাপাশি সমানুভূতির বোধ জাগ্রত করা : সাধারণ সহানুভূতির (sympathy) পাশাপাশি সমানুভূতির (empathy) বোধ শৈশব থেকেই অভ্যাস করাতে হবে। সমানুভূতি না থাকলে একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির প্রত্যাশাকে মূল্যায়ন করে না। সমানুভূতিহীন ব্যক্তি সহজেই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। যার মধ্যে সমানুভূতির বোধ আছে, তার পক্ষে অসদাচরণ, মিথ্যাচার, প্রতারণা, দুর্নীতি বা অন্যের ক্ষতি করার মতো নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কম। সমানুভূতিসম্পন্ন একজন ব্যক্তি সৎ, উদার ও নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে খুব সহজেই।

সন্তান ভুল বা খারাপ কিছু করলে নির্বিচারে বকাঝকা না করে তার পাশে দাড়ানো : মিথ্যা বলা, অন্যের সাথে ঝগড়া বা মারামারি করা কিংবা পরীক্ষায় খারাপ করা - এসব ঘটনায় বাবা-মায়েরা প্রায়ই সন্তানকে প্রথমেই বকাঝকা বা মারধোর করেন। এমন করা একেবারেই ঠিক নয়। জানার চেষ্টা করতে হবে, কেন সে এমন করলো। তাকে সময় দিতে হবে এবং সহযোগিতা করতে হবে যেন সে নিজের ভুল-ত্রুটি বুঝতে পারে এবং ভবিষ্যতে এমন করা থেকে বিরত থাকে।

এগুলো খুব সাধারণ কিছু আচরণ যা বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সাথে দৈনন্দিন আচরণের মধ্যে প্রয়োগ করতে পারেন। এতে সন্তানদের মধ্যে খুব সহজেই সততা, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার সার্বিক বোধ জাগ্রত হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্তানকে সময় দেওয়া, তাকে মনোযোগ দেওয়া এবং তাকে বুঝতে চেষ্টা করা। বাবা-মায়ের সাথে ভালো বোঝাপড়া ও ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলে সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবেই ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।