নয়া মাধ্যম, ফেইক নিউজ ও ক্লিকবেইট জার্নালিজম
সজীব সরকার
প্রকাশিত: ১৮:৪৯, ১২ আগস্ট ২০২২
ভুয়া খবরকে এমনভাবে পাঠকের সামনে হাজির করা হয় যেন তারা এটিকে সত্যিকার সংবাদ অর্থাৎ সত্য বলে মনে করে। ছবি : সংগৃহীত।
ফেইক নিউজ (fake news) বলে একটি অভিধা এখন বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ফেইক নিউজ আসলে কোনো নিউজ নয়; 'ভুয়া খবর' স্বাভাবিকভাবেই কোনো খবর নয়। কেননা, ফেইক তথা মিথ্যা বা ভুয়া কোনো তথ্য খবর বা সংবাদ হতে পারে না; সংবাদ হতে হলে এর মধ্যে সত্যতা বা বস্তুনিষ্ঠতা থাকতেই হবে। বাস্তবতা-বিবর্জিত কোনো তথ্য সংবাদ হতে পারে না। সাংবাদিকতার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক আলোচনায় প্রচলিত রয়েছে : News is based on facts; fiction is not news.
বর্তমান সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এলেও ফেইক নিউজের ধারণাটি একেবারে নতুন নয়। সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসের একেবারে শুরু থেকেই খবর আর ভুয়া খবরের এই দ্বন্দ্ব পাঠককে আন্দোলিত করেছে। তবে নতুন প্রযুক্তির যুগে অনলাইন পত্রিকা বিকশিত হতে শুরু করার পর থেকে ফেইক নিউজের দৌরাত্ম্য নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম) নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার ফেইক নিউজ ও নানা ধরনের গুজবকে আরো উস্কে দিচ্ছে। এমনকি, এ চর্চা এখন অনেকের জন্যে আর্থিকসহ অন্যান্য উপায়ে 'লাভজনক' হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তি সহজলভ্য হলে এর যেসব অপব্যবহার হতে পারে, ভুয়া খবর ও গুজবের 'ব্যবসা' সেগুলোরই একটি উদাহরণ।
অনলাইন পত্রিকাগুলোর তথাকথিত জনপ্রিয়তা ও আর্থিক প্রাপ্তিযোগ অনেকখানিই নির্ভর করে এদের পাঠকসংখ্যার ওপর। পাঠক বেশি হলে বেশি লাভ আর পাঠক কম হলে কম লাভ বা লস। এই সরল সমীকরণ অনলাইন সাংবাদিকতার জগতে একটি অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। হাজারো পত্রিকার ভীড়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে অনেক পত্রিকাই সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে নানা ধরনের তথ্যকে 'চটকদার ও আকর্ষক' শব্দ-বাক্য-ছবি দিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরছে। যে খবরের আকর্ষণ যতো বেশি, ওই খবর পাঠক টানে ততো বেশি। এজন্যে মূলত যৌনতা এবং গুজব বা রটনাকে আশ্রয় করে অরুচিকর ভাষায় ও অশালীন ছবি ব্যবহার করে পত্রিকাগুলো পাঠক টানছে। এভাবে একদিকে যেমন মিথ্যা তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে, অন্যদিকে আবার একটি বস্তুনিষ্ঠ বা সত্য খবরকেও চটকদার করে তুলতে গিয়ে সেটিও একরকমের অর্ধ-সত্য বা অশালীন বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।
বিশেষ করে ভুয়া খবরকে এমনভাবে পাঠকের সামনে হাজির করা হয় যেন তারা এটিকে সত্যিকার সংবাদ অর্থাৎ সত্য বলে মনে করে। অবশ্য এটি যে সত্য নয়, পাঠক তা বুঝলেও খুব সমস্যা নেই; আকর্ষণীয় ভাষা ও ছবি (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা যৌন-উদ্দীপক) দেখে অনেক পাঠকই ওই খবরে 'ক্লিক' করতে বাধ্য হয়। আর এতেই পত্রিকাগুলোর লাভ; প্রতিদিন যদি এভাবে 'ক্লিক'-এর সংখ্যা অর্থাৎ পাঠক বা ভিজিটর বাড়ানো যায়, তাতেই পত্রিকাগুলোর লাভ।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কে অ্যাকাউন্ট তৈরি করছে আর কে, কী শেয়ার করছে- এর ওপর কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই সুযোগে একই কৌশল কাজে লাগিয়ে এসব পত্রিকা সোশ্যাল মিডিয়াতেও তাদের ফলোয়ার-লাইক-সাবস্ক্রিপশন তথা পাঠক বাড়াচ্ছে।
পাঠকরা এখন খবর বা বিনোদনের জন্যে মূলত সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে পাঠক যোগাড় করতে এ ধরনের পত্রিকাগুলো খবর ও বিনোদনের নামে অর্ধ-সত্য, গুজব ও অরুচিকর যৌন-উদ্দীপক আধেয় প্রচার করাকেই মূল কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। বিষয়টি অনেকটাই বড়শিতে টোপ লাগিয়ে মাছ শিকারের মতো; ক্লিক বাড়ানোর এই কৌশলকে তাই বলা হয় ক্লিকবেইট (clickbait)।
অনলাইন পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেইক নিউজ প্রচারের বা এদের কাঙ্ক্ষিত কোনো আধেয় বা সাইটে পাঠককে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। এজন্যে ওয়েবের কোনো একটি পাতায় খুব আকর্ষক একটি টেক্সট বা ছবি কিংবা গ্রাফিক্স দেওয়া হয় যাতে আকৃষ্ট হয়ে পাঠক ওই অংশে 'ক্লিক' করে। পাঠক সেখানে ক্লিক করার পর অন্য একটি পাতা উন্মুক্ত হয় (উদ্দিষ্ট লিংক)। সাংবাদিকতার পরিভাষায় এর নাম ক্লিকবেইট জার্নালিজম।
ফেইক নিউজ এখন 'হলুদ সাংবাদিকতা'র (yellow journalism) সীমাকে অতিক্রম করেছে। নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে এসব পত্রিকা, যাদের পুঁজিই হলো ভুয়া খবর ও গুজব, স্থান ও কালের সীমাকে অতিক্রম করে এসব আধেয় ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তের পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে। এসব তথ্যে সত্য বলতে কিছু থাকে না বা থাকলেও তা নগণ্য কিন্তু একে বহুগুণ বাড়িয়ে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এবং রং চড়িয়ে পাঠকের সামনে হাজির করে এসব পত্রিকা লাভজনক হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এর বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা।
এই দিকটিতে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। এসব আধেয়ের উৎস (পত্রিকা) ও গন্তব্য (পাঠক) - উভয় দিকেই সচেতনতা বাড়ানো খুব জরুরি। না হলে এতে দীর্ঘমেয়াদে কেবল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা মানবজাতি।
সজীব সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা : মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইজেড।