জাপানে বন্দুক হামলা কেন বিরল
ফিচার ও মতামত ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ৯ জুলাই ২০২২; আপডেট: ০১:২০, ২৯ অক্টোবর ২০২২

জাপানে অস্ত্র কেনা খুব কঠিন। এ কারণে শিনজো আবের হত্যাকারী হাতে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে। ছবি : নাইন নিউজ।
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে আততায়ীর গুলি করে হত্যার ঘটনা নানা কারণেই বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। এই বিস্ময় কেবল গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিহত হওয়ার কারণেই নয়; দেশটিতে বন্দুক চালিয়ে এভাবে কাউকে হত্যার মতো ঘটনাই একেবারে বিরল। এর একটি বড় কারণ হলো দেশটিতে বিদ্যমান অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন অনেক কঠোর। এ ছাড়াও, দেশটির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলই এমন যেখানে নাগরিকদের মধ্যে এমন সহিংসতার মানসিকতা তৈরি হওয়াও খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার। এসব কারণে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারজনিত সহিংসতার ঘটনা জাপানেই সবচেয়ে কম।
৮ জুলাই ২০২২ শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যার ঘটনার আগে জাপানে একজন রাজনীতিবিদের ওপর জনসমক্ষে গুলি চালানোর সর্বশেষ ঘটনা ঘটে ২০০৭ সালে। ওই বছর নাগাসাকির মেয়র ইচ্চ ইতোকে এক 'গ্যাংস্টার' খুব কাছ থেকে অন্তত দুটি গুলি করলে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর দেশটিতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন আরো কঠোর করা হয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রাও আগের চেয়ে আরো বাড়ানো হয়। পরিবর্তিত আইনে সংগঠিত অপরাধী চক্রের ক্ষেত্রে অস্ত্র রাখার শাস্তি বাড়িয়ে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। একজন ব্যক্তির একাধিক অস্ত্র রাখাও অপরাধের আওতায় নেওয়া হয়েছে এবং এরও শাস্তি ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। আর জনসমক্ষে বা প্রকাশ্যে গুলি ছোঁড়ার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের জন্যে কঠোর শাস্তিই শুধু নয়, দেশটিতে অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াও অনেক কঠিন। জাপানের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে সাধারণ নাগরিকদের কাছে কেবল শটগান ও এয়ার রাইফেল বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর এগুলো কেনার অনুমতি পেতেও যেতে হয় বেশ জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেতে আবেদনকারীকে দিনব্যাপী ক্লাস, লিখিত পরীক্ষায় পাস এবং নিশানার পরীক্ষায় (শ্যুটিং রেঞ্জ টেস্ট) অন্তত ৯৫ শতাংশ সাফল্য অর্জন করতে হয়। এ ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং মাদকাসক্তি নির্ণয়ের পরীক্ষাতেও পাস করতে হয়। এরপরও আবেদনকারীর অতীত বিস্তারিতভাবে ঘেঁটে দেখা হয়, যার মধ্যে রয়েছে কোনো ধরনের অপরাধের ইতিহাস, ব্যক্তিগত ঋণ, অপরাধী চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে আবেদনকারীর সম্পর্কের মানসহ নানাবিধ বিষয়ের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ।
এখানেই শেষ নয়; আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার পর অস্ত্রটির তথ্য পুলিশের কাছে নথিভুক্ত করাতে হয়। অস্ত্র ও এর গুলি আলাদা দুটি স্থানে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখতে হয় এবং ওই তথ্যও সবিস্তারে পুলিশের কাছে লিপিবদ্ধ করাতে হয়। পুলিশ বছরে একবার বাধ্যতামূলকভাবে ওই অস্ত্র সরেজমিনে পরিদর্শন করে। অস্ত্রের মালিককে ৩ বছর পরপর নতুন করে ক্লাস এবং পরীক্ষা পাসের মধ্য দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করাতে হয়।
এতো কঠোর নিয়মের কারণে জাপানে সাধারণ নাগরিকদের হাতে অস্ত্রের সংখ্যা একেবারেই কম। ২০১৭ সালে জাপানের ১২ কোটি ৫০ লাখ নাগরিকের বিপরীতে বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে মোট অস্ত্রের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন নাগরিকের হাতে অস্ত্রের সংখ্যা গড়ে শূন্য দশমিক ২৫ বা ০.২৫%। এর বিপরীতে, জেনেভায় অবস্থিত গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জনে অস্ত্রের সংখ্যা ১২০। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের হাতে প্রায় ৩৯৩ মিলিয়ন আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতাজনিত মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি। ইউনিভার্সিটি অব সিডনির সিডনি স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর সংগ্রহ করা তথ্যে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারজনিত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩৯,৭৪০টি। আর ১২৫ মিলিয়ন মানুষের দেশ জাপানে ওই বছর এ ধরনের সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা ৯টি। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ নামের একটি অলাভজনক গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র ব্যবহারজনিত সহিংসতায় ২০২২ সালের এ সময় পর্যন্ত ২০,৯০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দেশটির নাগরিকদের বড় একটি অংশই সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সুরক্ষিত 'অস্ত্র অধিকার' বজায় রাখার পক্ষে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এমনকি শিশু-কিশোরদের হাতেও বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অস্ত্র সহজলভ্য; কদিন পরপর দেশটিতে চার্চ, স্কুল, পার্ক বা শপিং মলের মতো উন্মুক্ত জনসমাগমস্থলে বা পাবলিক প্লেসে বন্দুক চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার ঘটনা তাই নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু জাপানের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই উল্টো; আইন কঠোর হওয়ার কারণে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র একেবারেই সহজলভ্য নয়। শিনজো আবেকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের ধরনও এ কথাই প্রমাণ করে। তেতসুইয়া ইয়ামাগামি নামে এক ব্যক্তি শিনজো আবেকে হত্যা করেছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ইয়ামাগামির কাছে পাওয়া এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বন্দুকটি ঘরে অর্থাৎ হাতে তৈরি।
এসব কারণে জাপানের মতো দেশে জনসমাবেশস্থলে শিনজো আবেকে হত্যার ঘটনা দেশটির নাগরিকদের কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার। বিশ্বের অন্যান্য দেশও, যারা জাপানের অহিংস সামষ্টিক সাংস্কৃতিক আবহের সঙ্গে পরিচিত, এ ঘটনায় বিস্ময় জানিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও এখন জাপানের ভবিষ্যত গতিপথ নিয়ে নানা ধরনের চিন্তা-ভাবনা তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার এ ঘটনা দেশটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি রাজনৈতিক গতিপথ আমূল পাল্টে দিতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাউন্সিল-এর জাপান শাখার পরিচালক ন্যান্সি স্নো যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'এটি (আবের হত্যাকাণ্ড) কেবল বিরল ঘটনাই নয়, (জাপানের) সংস্কৃতিতে এ ঘটনা অবিশ্বাস্য। জাপানের নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো সবার হাতে হাতে বন্দুক থাকার এই চর্চার কথা ভাবতেই পারে না।' তিনি মন্তব্য করেছেন, শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যার এ ঘটনা জাপানকে চিরতরে বদলে দেবে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন ও টকঅবদ্যটাইম ডটকম।