মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ
নানামুখী নির্বাহী আদেশে দেশ ও দেশের বাইরে অস্থিরতা
ফিচার ও মতামত ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৪০, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০২:০৩, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই একের পর এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই একের পর এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে সরকারসহ পুরো রাষ্ট্রকেই একটি নতুন কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প স্বাক্ষরিত বিভিন্ন নির্বাহী আদেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো বাণিজ্য, অভিবাসন, বৈদেশিক সাহায্য, জাতিগত ভিন্নতা, নাগরিক অধিকার এবং কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মী নিয়োগের প্রচলিত ধারা পরিবর্তন ইত্যাদি।
এদিকে, গতকাল বুধবার ক্ষমতা গ্রহণের তৃতীয় দিনে নিজ কার্যালয় ওভাল অফিস থেকে তার প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেন ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ফক্স নিউজকে দেওয়া তার প্রথম এ সাক্ষাৎকারে অবৈধ অভিবাসী ও শরণার্থী সম্পর্কে ট্রাম্প বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের অযাচিত নীতির কারণে সারা বিশ্বের সব কারাগারগুলো খালি হয়ে গেছে এবং সব অপরাধী এই দেশে এসে জড়ো হয়েছে। আমার ধারণা বাইডেন নিজেও জানে না যে দেশে কি হচ্ছে! কিন্তু, এমনটা আসলে কে চাইবে?’
এখানে এ পর্যন্ত ট্রাম্পের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
ডিইআই : ডাইভারসিটি (বৈচিত্র্য), সমতা (ইক্যুটি) এবং ইনক্লুসোন (অন্তর্ভুক্তি) সংক্ষেপে ডিইআই মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি আইন যেটি কর্মক্ষেত্রে নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর। ১৯৬০ সালে গৃহীত এ আইনটি বর্তমানে হুমকীর মুখে পড়েছে। কারণ, ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ট্রাম্প প্রশাসন এ আইনের আওতায় সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক বেতনসহ ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে।
গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা থেকে এটি কার্যকরের নির্দেশ রয়েছে। একইসঙ্গে, এ কর্মসূচীর আওতায় পরিচালিত সব ধরনের দফতরও বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্পের মতে, এটি একটি পক্ষপাতমূলক ও ব্যয়বহুল প্রকল্প।
মার্কিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এ আইন বাস্তবায়নে বাৎসরিক ৮ বিলিয়ন ডলার বাড়তি খরচ করতে হয় বলে ধারণা করা হয়।
ফলে, মাইক্রোসফটসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এখনও এ সুবিধা চালু রাখলেও ওয়ালমার্ট, ম্যাকডোনাল্ডস, অ্যামাজন ও মেটার মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো এরইমধ্যে এ সুবিধা বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
তবে, নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ট্রাম্পের এ আদেশের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
অভিবাসন : অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ট্রাম্পের জারি করা আদেশ গতকাল থেকেই পুরোদমে কার্যকর হতে শুরু করেছে। কারণ, এরইমধ্যে মেক্সিকো সীমান্তের দক্ষিণাংশে ১ হাজার ৫০০ সেনা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট সালেসেস।
এছাড়া, অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী শরণার্থী, যাদেরকে চুরি বা অন্য কোনো সহিংসতার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছিলো, বিচার চলাকালে তাদের কারাগারে প্রেরণের জন্য কংগ্রেসে এরইমধ্যে একটি বিল পাস করা হয়েছে।
জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের নার্সিং কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ল্যাকেন রাইলির সম্মানে এ বিলটিরও একই নামকরণ করা হয়েছে। গত বছর ভেনেজুয়েলার এক পুরুষ শরণার্থী তাকে হত্যা করে। খুব শিগগিরই এ বিলটি হোয়াইট হাউসে আইন আকারে পাস হতে যাচ্ছে।
এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘যেকোনো ধরনের অবৈধ অনুপ্রবেশ যত দ্রুত সম্ভব ঠেকানো হবে এবং আমরা এ দেশে থাকা লাখ লাখ অপরাধীদের তারা যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’
এদিকে, এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অভিবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শেইনবাম জানিয়েছেন। একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে ভারত।
বার্থরাইট সিটিজেনশীপ : ক্ষমতা গ্রহণের পরই জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক হওয়ার আইনটি বাতিলে আরেক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন ট্রাম্প। এ আইনের আওতায় বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শরণার্থী ও অভিবাসীর সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে জন্মসূত্রে তারা মার্কিন নাগরিক হওয়ার সুবিধা পেয়ে আসছিলো।
তবে, এরইমধ্যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পের এ আদেশের বিরুদ্ধে আইনি উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের মতে, সংবিধানেই এ সুবিধা সংরক্ষিত রয়েছে।
এদিকে, গতকাল এক শুনানির মধ্য দিয়ে বার্থরাইট সিটিজেনশীপ নিয়ে ট্রাম্পের আদেশের উপর সাময়িক স্থগিতাদেশ দিয়েছে মার্কিন বিচারক। আইনটি সংবিধানে সুরক্ষিত রয়েছে, এ যুক্তিতে এ উদ্যোগ নেয় আদালত। এ আদেশ পুরোপুরি অসাংবিধানিক বলেও মত দিয়েছেন বিচারক।
লৈঙ্গিক বৈচিত্র্য : নিজ দেশে শুধু নারী ও পুরুষ ছাড়া আর কোনো ধরনের লৈঙ্গিক বৈপরিত্যকে প্রশ্রয় দিবেন না বলে অঙ্গীকার করেছেন ট্রাম্প। এটি পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এরইমধ্যে আরও একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন ট্রাম্প।
তবে, তার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এরইমধ্যে সোচ্চার হয়েছে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো। 'এলজিবিটিকিউপ্লাস' (LGBTQ+) নামে পরিচিত এ সম্প্রদায়ের নাগরিকরা এরইমধ্যে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে।
রাশিয়া : ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সম্মত না হলে যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার বিক্রিত যেকোনো ধরনের পণ্যের উপর উচ্চহারে ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ করা হবে বলে হুমকী দিয়েছেন ট্রাম্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উদ্দেশ্য করে ট্রাম্প বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় এ যুদ্ধ বন্ধ করে ঘরে ফিরে যাও। কারণ, দিন দিন এটি শুধু খারাপই হতে থাকবে।’
তবে, ট্রাম্পের এ সতর্কবার্তার পর তার দেশের সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন পুতিন।
চীন : আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে চীনা পণ্যের উপর ১০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। তার এ সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ট্রাম্প জানান, চীন মেক্সিকো ও কানাডা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেনটালিন জাতীয় দ্রব্য রফতানি করছে। নেশাজাতীয় এ দ্রব্যটি দেশজুড়ে মাদক সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
একইসঙ্গে, মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যের উপরও আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর হুমকী দিয়েছেন তিনি। দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীর প্রবেশ ও মাদক চোরাচালান ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়াই তার এ হুমকীর কারণ বলে ট্রাম্প জানান।
তবে, এ সমস্যা সমাধানে ট্রাম্প সরকারের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে চীন।
নির্বাচনী প্রচারের পুরো সময়জুড়েই ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। কারণ, তার মতে, এতে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এর ফলে পণ্যের দাম বাড়ার মধ্য দিয়ে নাগরিকের খরচই শুধু বাড়বে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
এছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে আনার মতো ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এরইমধ্যে তোলপাড় তুলেছে সারা বিশ্বে। একইসঙ্গে, বেশ কিছুদিনের জন্য আন্তর্জাতিক অনুদানও বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর এর বড় একটি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।
এদিকে, বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক বন্ধের কয়েক দিনের মধ্যেই তা আবার চালু করে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু, চীনের জনপ্রিয় এ অ্যাপ আদতে মার্কিন নাগরিকদের উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য চালু করা হয়েছিলো বলে ট্রাম্প মনে করেন।
উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর গতকাল প্রথমবার কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন ট্রাম্প। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এ সম্মেলনে ভার্চুয়্যালি যুক্ত হয়ে এখানেও তার ব্যতিক্রমী বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা জানান ট্রাম্প।
এ নিয়ে এরইমধ্যে বিশ্ব নেতাদের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় কোনো প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য তৈরি না করলে তাদের উপর ট্রিলিয়ন ডলারের শুল্ক আরোপ করা হবে বলে সতর্ক করেন ট্রাম্প।
তবে, কানাডা বিষয়ে তার করা মন্তব্যটি ছিলো এ পর্যন্ত সম্মেলনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কারণ, কানাডা নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে মেনে না নিলে যুক্তরাষ্ট্রের আর কানাডার গাড়ি বা কাঠের প্রয়োজন নেই বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সূত্র : আল-জাজিরা, সিএনএন, বিবিসি, ডয়চে ভেলে।