শ্রম ও শ্রমিকের প্রকৃত মূল্যায়ন হোক
সজীব সরকার
প্রকাশিত: ১৬:২২, ১ মে ২০২৪; আপডেট: ১৬:৪৫, ১ মে ২০২৪
উৎপাদিত পণ্য ও সেবায় শ্রমিকের যৌক্তিক, ন্যায্য ও প্রকৃত অধিকার পুঁজির মালিকদের উপলব্ধি করতে হবে। ছবি : সংগৃহীত।
কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদনের একাধিক উপাদান থাকলেও বরাবরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে আসছে 'পুঁজি'। উৎপাদিত পণ্য বা সেবায় শ্রম ও শ্রমিকের ভূমিকার ওপর থেকে সচেতন কৌশলে সবার দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে ভারসাম্যহীন ও অন্যায্য উৎপাদন ব্যবস্থা, ভারসাম্যহীন শ্রমবাজার ও সার্বিক অর্থনীতি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচালন কৌশল পুঁজিকে রীতিমতো 'গ্লামারাইজড' করে রেখেছে। অযৌক্তিক ও অনিয়ন্ত্রিত ভোগবাদিতা পুঁজির অযৌক্তিক ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গণমাধ্যমগুলো পুঁজি বা সম্পদের এমন এককেন্দ্রিকরণের প্রবণতাকে প্রশ্ন করবে এবং ন্যায্য বা সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কিন্তু, তা না করে বিশ্বজুড়েই গণমাধ্যমগুলো বরং পুঁজির বিশ্বস্ত 'পাহারাদার' হয়ে উঠেছে।
দেশের শীর্ষ ধনী, এশিয়ার শীর্ষ ধনী কিংবা বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকা; কোন বিলিয়নেয়ারের বাড়ির অভ্যন্তর দেখতে কেমন, বিশ্বের কোন কোন দেশে তার বাড়ি কিংবা কতোগুলো বাড়ি, কার গাড়ি কতোগুলো এবং এমন অনেক চর্চা পুঁজি বা সম্পদের সমবণ্টনের সমান সুযোগের আদর্শের পরিপন্থী। এভাবে গণমাধ্যমগুলোও প্রকারান্তরে এমন অন্যায় ব্যবস্থাকেই প্রশ্রয় দিয়ে থাকে।
ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক পর্যায়ে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অনিয়ম-দুর্নীতির খবরে গণমাধ্যমের আগ্রহ অনেক কম। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর আরো অনেক অনুসন্ধান করার সুযোগ ও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু, তা না করে গণমাধ্যমগুলো বরং 'ফ্যাশন' বা 'লাইফস্টাইল' সাংবাদিকতার নামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সীমাহীন ও অযৌক্তিক ভোগবাদিতার প্রচারপত্র হয়ে উঠেছে।
মে দিবস আজ। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে অনেক কথা হবে হয়তো। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি, অধিকার আদায়ের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনে নেমে জীবন দিতে হয়েছিলো শ্রমিকদের। কিন্তু, তাদের অধিকার শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কতোটা? এখন পর্যন্ত শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে কি? তাজরিন কিংবা রানা প্লাজার ভিকটিমদের কে কোথায় আছে, কেমন আছে - সে খবর কেউ রেখেছে কি? তারা প্রকৃত ন্যায়বিচার পাবে কি? এখনও প্রতি বছর প্রতি ঈদের আগে বেতন-ভাতা-বোনাস এমনকি বকেয়া বেতনের দাবিতে পোশাকখাতের শ্রমিকদের সড়কে আন্দোলনে নামতে হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ-গৃহকর্মের মতো অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) খাতের শ্রমিকদের অবস্থা আরো নিদারুণ; তাদের দুবির্ষহ অবস্থার কথা গণমাধ্যমেও উঠে আসে কদাচিৎ।
নারী ও পুরুষের মধ্যে মজুরি বৈষম্য দূর হয়নি। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনের সুরক্ষা এবং সার্বিকভাবে নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। যৌক্তিক মজুরি বা বেতন কাঠামো নেই। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। এসব ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলোর মনোযোগী হওয়া দরকার।
কেবল পুঁজি (বিশেষ করে অর্থ) কিছুই উৎপাদন করতে পারে না। পুঁজির সঙ্গে শ্রম যুক্ত হলেই উৎপাদন সম্ভব হয়। তাই, উৎপাদিত পণ্য ও সেবায় শ্রম তথা শ্রমিকের যৌক্তিক, ন্যায্য ও প্রকৃত অধিকার পুঁজির মালিকদের স্বীকার করার সততা ও আন্তরিকতা থাকা দরকার। পুঁজির মালিকদের বুঝতে হবে, শ্রমের অবদান ছাড়া কেবল পুঁজি কিছুই উৎপাদন করে দিতে পারবে না এবং উৎপাদন ছাড়া তাদের মুনাফাও সম্ভব নয়। অর্থাৎ, পুঁজির মালিকদের সম্পদের (বা, সম্পদের পাহাড়ের!) পেছনে শ্রমিকদের ভূমিকা সীমাহীন।
এই উপলব্ধি থেকে অন্তত কৃতজ্ঞতার বোধ থেকে হলেও শ্রমিকদের প্রতি চলমান বৈষম্য ও অন্যায় দূর হোক, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।