বয়স কমতে যাচ্ছে কোরিয়ানদের!
ফিচার ও মতামত ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১:৪৮, ৯ মে ২০২২; আপডেট: ০১:৪৩, ২৯ অক্টোবর ২০২২
দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মের সময়ই শিশুর বয়স এক বছর বলে ধরে নেওয়া হয়।
‘তোমার বয়স কতো?’ এটি খুবই সাধারণ একটা প্রশ্ন, যার উত্তরটিও খুব সহজ। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আসলে ততো সহজ নয়। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন একটি শিশুর জন্ম হয় তখন শুরুতেই তার বয়স এক বছর বলে ধরে নেওয়া হয়! আর নতুন একটি বছর শুরু হলে তাদের বয়সের সঙ্গে যোগ হয় আরও এক বছর। অর্থাৎ ডিসেম্বরে জন্ম নেওয়া একটি শিশু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুই বছর বয়সী হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে কোরিয়ানদের বয়স গণনার এই পদ্ধতি খুব শিগগিরই বদল হতে যাচ্ছে। আর এ বদল আনা হলে সেখানকার নাগরিকদের বয়স এখন যতোটা গণনা করা হয়েছে, এর থেকে অন্তত একবছর কমবে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়োন সুক-ইয়োল বাতিল করতে চলেছেন শতাব্দি পুরনো এ নিয়ম। পুরো বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতেই পুরনো ও জটিল এ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। দেশটির সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশই একে সমর্থন জানালেও শেষ পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
একের ভেতর তিন!
কোরিয়ায় মূলত তিনটি পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তির বয়স গণনা করা হয়ে থাকে। সরকারিভাবে দেশটি আন্তর্জাতিক নিয়মেই একজন ব্যক্তির বয়স হিসেব করে। ১৯৬২ সাল থেকে এ পদ্ধতির চল হয়েছে যেখানে একজন ব্যক্তির জন্ম তারিখ থেকে স্বাভাবিক নিয়মে তার বয়স গণনা করা হয়।
এ ছাড়াও তাদের সরকারিভাবেই বয়স গণনার আরও একটি পদ্ধতি রয়েছে যেখানে কোনো শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে যে মাসেই জন্ম নিক না কেন, প্রতি বছরের পহেলা জানুয়ারি তার বয়সের ঘরে একটি বছর করে যোগ হয়। অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জন্ম নেওয়া কোনো শিশু ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতেই দুই বছর পূর্ণ করে ফেলে, যদিও সত্যিকার অর্থে দুই বছর হতে তার আরও অনেকগুলো মাস বাকি থাকে।
মূলত দেশটির বিভিন্ন এলাকার আইন অনুযায়ী সে এলাকায় বসবাসরত ব্যক্তির আইনি বয়স নির্ধারণের জন্যই এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশের জন্য ব্যাপকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ; কেননা, সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বা কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানি থেকে রক্ষায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এ পদ্ধতিতে গণনা করা বয়স জানাটা তাদের সমাজে প্রয়োজন হয়।
এরপর রয়েছে বয়স গণনার আরও একটি পদ্ধতি যা ওই সমাজের প্রায় সবাই ব্যবহার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে, যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, তখন জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তার বয়সের খাতায় রাতারাতি একটি বছর যোগ হয়ে যায়; অর্থাৎ ওই শিশু জন্মই নেয় এক বছর বয়সে! এরপর তার জন্মের মাস ও তারিখ যা-ই হোক না কেন, প্রতি নতুন বছরে তার বয়সের ঘরে যোগ হতে থাকে নতুন আরেকটি বছর।
আর এই হিসাবে বর্তমানে কোরিয়ার তুমুল জনপ্রিয় পপ সঙ্গীত দল বিটিএস-এর সঙ্গীততারকা কিম তায়-হুয়ান, যিনি ‘ভি’ নামে পরিচিত, তিনি ১৯৯৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করলেও কোরিয়ার স্থানীয় পদ্ধতিতে বর্তমানে তার বয়স ২৮ বছর, আন্তর্জাতিক বয়সের হিসাবে ২৬ এবং কোরিয়ার সরকারি পদ্ধতিতে ২৭ বছর!
অনেকের কাছে বয়সটা শুধু কিছু সংখ্যা ছাড়া আর হয়তো কিছু নয়। কিন্তু কোরিয়ার মতো দেশে বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোরীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক শিন জি-ইয়ং এ বিষয়ে বলেন, ‘সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একজন দক্ষিণ কোরীয়র কাছে কারও বয়স জানাটা তার নাম জানা থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোনো ব্যক্তি কারও থেকে বয়সে বড় না ছোট, এর ওপর নির্ভর করে তাকে কীভাবে সম্বোধন করা হবে।’
কোরিয়ায় বয়স গণনার এ পদ্ধতির মূল উৎস মূলত চীন। এ ছাড়াও এশিয়ার আরও কিছু অংশেও এ পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়। তবে এর মধ্যে বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়াই একমাত্র দেশ যারা এখনও এ পদ্ধতি বহাল রেখেছে।
‘বিশ্বয়ানের কারণে এখন অনেক কোরীয় নাগরিকই আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে বয়স গণনার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। দেশটির তরুণদের ওপর অবশ্যই এর একটি প্রভাব পড়ছে, কারণ কোরীয়দের বয়স গণনার প্রাচীন এ পদ্ধতি এখন একটি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে তারা মনে করছে।’ - এমনটাই মনে করছেন দেশটির হানসানং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নীতি বিভাগের অধ্যাপক কিম ইয়ুন-জু।
তবে হাস্যকর হোক আর যা-ই হোক, কোরিয়ানদের ওপর সত্যিকার অর্থেই এর একটি বিরাট প্রভাব পড়ছে। কেননা, দেশটির অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধনের সময় অসৎ উপায় অবলম্বন করেন। কারণ তাদের ভয় যে তাদের ডিসেম্বরে জন্ম নেওয়া সন্তান হয়তো ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি পদেই এ বয়সের কারণে অসুবিধায় পড়বে।
করোনা মহামারির সময়ও কোরিয়ায় বয়স গণনার বিষয়টিকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়ে আলোচনা হয়। কেননা টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও প্রচলিত পদ্ধতির মধ্যে ব্যাপক সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়াও বাড়তি মজুরি বা চাকরি থেকে অবসরের সময়ও প্রায় প্রত্যেক নাগরিককেই বয়স নিয়ে এতই জটিল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় যে প্রায় ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আর এ সবই বাড়তি সময় ও অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয় বলেই মনে করেন অনেকে।
প্রথা কি তাহলে বাতিল হতে যাচ্ছে?
দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের জন্য বয়স গণনার একক একটি পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ দেশটির সরকারের জন্য এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ ও ২০২১ সালেও দুজন আইনজীবী এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর চূড়ান্তভাবে আইন আকারে পাস করা সম্ভব হয়নি। তবে এরই মধ্যে এ প্রথায় পরিবর্তন আনলে কোরীয় সমাজে এর কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও একটি বিষয়ে তারা সবাই একমত যে, প্রস্তাবটি অবশ্যই প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যৌক্তিক।
তবে শেষ পর্যন্ত বয়স গণনার আন্তর্জাতিক পদ্ধতির প্রচলন হলেও দেশটির নাগরিকরা খুব শিগগিরই পুরনো প্রথাগুলো বাতিল করবে না - বিশেষজ্ঞরা এমনটিই মনে করছেন।
সূত্র : বিবিসি।