ইহাদের লইয়া আমরা কী করিব!
সজীব সরকার
প্রকাশিত: ১৩:৫৩, ১২ এপ্রিল ২০২৩; আপডেট: ২১:৪৫, ১২ এপ্রিল ২০২৩
ভালোর মধ্যেই ভাবনা শেষ হোক; প্রদীপের নিচে লুকোনো অন্ধকারের মতো ভালো ভাবনার ছায়ায় মন্দের আস্কারা ভালো কথা নয়। ছবি : লেখক।
আজ সকালে অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাতে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির দিকে নজর গেল। পরনে সাদা ট্রাউজার ও সাদা গেঞ্জি আর কাঁধে একটা ঝোলা। হাতে ছোট্ট একটি প্ল্যাকার্ড। এতে লেখা, 'অসৎ সঙ্গ চাই না'। মূলত এই লেখার কারণেই ব্যক্তিটির দিকে দৃষ্টি পড়েছিলো। লোকটির সঙ্গে কথা বলবো কি বলবো না, তা ভাবতে ভাবতেই আমাকে বহনকারী রিকশাটা টেনে চলে গেল। সাধারণত এ রাস্তায় সকালবেলা বেশ লম্বা সময় ধরে সিগনালে আটকে থাকি; আজ অল্পতেই ছাড়া পেয়ে রিকশাটা এক টানে অনেকদূর চলে গেল। আবার পিছু ফিরবো কি না, কথা বলেই বা কী হবে, অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাবে - এমন নানাকিছু ভাবতে ভাবতে আনমনেই রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়লাম। পেছনদিকে হাঁটা শুরু করলাম।
তখনও লোকটি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?' লোকটি খুব খুশি হয়েছে মনে হলো; হেসে বললেন, 'অবশ্যই কথা বলা যাবে। জিজ্ঞেস করুন, কী জানতে চান।'
তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
- আপনার নাম কী?
- সমর (ছদ্মনাম)।
- কোথায় থাকেন? আপনার বাড়ি কোথায়?
- নারায়ণগঞ্জ।
- বয়স কতো হবে আপনার?
- ৪৫।
- কী করেন আপনি?
- ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গের অনুসারী আমি।
- আপনি এই কথা ('অসৎ সঙ্গ চাই না') লিখে এখানে দাড়িয়েছেন। কেন? কী করতে চান আপনি?
- আমি ইসলাম প্রচার করতে চাই। আর অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ প্রচার করতে চাই। মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ আর অনুকূল ঠাকুরের কথা প্রচার করতে চাই।
আমি জানি, প্রচলিত ধর্মগুলোকে অনুকূল ঠাকুর প্রচলিত অর্থে 'ধর্ম' হিসেবে না দেখে বরং 'মত' হিসেবেই দেখতেন। তাই অনুকূল চন্দ্রের এই অনুসারীকে একাধিক ধর্ম প্রচার করতে দেখে অবাক না হয়ে বরং দুটো ধর্মকে প্রচলিত অর্থে ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করে প্রচার করতে দেখেই অবাক হলাম। তাকে বললাম-
- বাহ, ভালো তো। কিন্তু মানুষ তো যে-কোনও একটা ধর্ম প্রচার করে। আপনি দুটো প্রচার করছেন। কেন? কারণ কী?
- আসলে মানুষ যে এই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে কতো ভুল... মানুষ যে কতো ভুল করেছে, আল্লাহ-ভগবান যা-ই বলি, তিনি মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি এটাই মানুষের কাছে প্রচার করতে চাই।
- আপনি এখানে অসৎ সঙ্গ চান না লিখে দাড়িয়েছেন। কেন দাঁড়িয়েছেন, বা কী বলতে চান- একটু স্পষ্ট করে বলবেন?
- আমি সবাইকে বলতে চাই, জানাতে চাই, সবাই যেন সৎ হয়। কেউ যেন অসৎ কর্ম না করে। অসৎ কর্ম করলেই সব শেষ। সরকারি অফিসে কেউ যদি অসৎ কর্ম করে, তাহলে কী হবে? সবকিছু শেষ। আপনি যদি অসৎ হন, অসৎ কর্ম করেন, তাহলে কিন্তু সব শেষ।
- আপনার কী মনে হয়; এই যে আপনি এখানে এটি লিখে দাঁড়িয়ে আছেন, মানুষ আপনার কথা শুনবে? সৎ থাকার চেষ্টা করবে?
- হ্যাঁ। আমি তো সেটাই প্রচার করছি। মানুষ যেন সৎ থাকে।
- ভালো কাজ করছেন। কিন্তু, আপনাকে এটা কে করতে বললো?
- ঠাকুর অনুকূল। বাবার ভক্ত আমি। তার কথায় আমি সৎসঙ্গের প্রচার করছি। তিনি বলেছেন সৎসঙ্গ প্রচার করতে, তিনি বলেছেন মানুষকে সৎ থাকতে।
- হ্যাঁ, তা ঠিক। অনুকূল ঠাকুর তো বলেছেন, 'সাধু সেজো না, সাধু হও।' আপনার চেষ্টা সফল হোক। আপনি ভালো থাকবেন। আমি এখন যাই তাহলে। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
প্রথমে 'আচ্ছা' বলে আমাকে বিদায় দিতে গিয়েও পরে থামালেন। বললেন-
- আপনার পরিচয়টা তো জানা হলো না। নাম কী আপনার? আপনি কী করেন?
- আমার নাম সজীব। আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়াই। আমার ছোটখাট একটা পত্রিকাও আছে; ভাবছি আপনার এই বিষয়টা সেখানে দেবো।
এ কথা শুনে তিনি বেশ খুশি হয়ে পত্রিকার নাম জানতে চাইলেন। আমি নামটা বললাম। এরপর তিনি বললেন-
- সজীবদা, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
- অবশ্যই। বলুন, আমি শুনবো।
- আপনি কিন্তু সৎ থাকবেন।
- অবশ্যই থাকার চেষ্টা করবো।
- সৎ যেহেতু হবেনই, তাহলে সৎকর্মের দীক্ষাটা অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ থেকেই নিয়ে নিন।
- নেবো।
- সজীবদা, আমি আপনাকে আরেকটা কথা বলতে চাই। আপনাকে সাবধান করতে চাই।
- অবশ্যই।
- আপনার মাথার পেছনে কিন্তু একটা নারী ঘুরছে; একটা নষ্টা নারী ঘুরছে। সে কিন্তু আপনাকে অসৎ করতে চায়।
- নারীটা কে?
- সজীবদা, এই নারীটা কিন্তু সবসময় আপনাকে অসৎ করার চেষ্টা করছে। আপনি যদি তার মুখের এইটুকু দেখে অসৎ কর্ম করেন, তাহলে কিন্তু আপনি শেষ। আপনার জীবন শেষ। সব শেষ।
- সব শেষ? ঠিক আছে। তাহলে তার মুখের দিকে তাকাবো না।
- এই ঢাকা শহরে নষ্টা নারীরা কিন্তু অসৎ করার চেষ্টা করছে। অসৎ হলেই কিন্তু শেষ। অসৎ কর্ম করা যাবে না।
- হ্যাঁ, তাই তো। ঠিক বলেছেন। আমি এখন আসি তাহলে।
যখন থেকে ওই ব্যক্তি অসৎ কর্মের সঙ্গে '(নষ্টা) নারী' কথাটা যোগ করেছেন, তখন থেকেই আর তার সঙ্গে কথা বলার রুচি হচ্ছিলো না। একবার মনে হচ্ছিলো, আর কথা না বাড়িয়ে চলে যাই। আবার মনে হলো, এখানে নারীকে দোষারোপের কারণটা কী, তা একবার জিজ্ঞেস করি। তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, নারীদের সম্বন্ধে এতো বাজে কথা বলা সাধুতার মধ্যে পড়ে কি না। কিন্তু পরে ভাবলাম, তার এমন ভাবনার কারণটা তো আসলে অজানা কিছু নয়। আর এদের সঙ্গে আমি যুক্তির জোরে তর্ক করলেও শেষ পর্যন্ত এরা গায়ের জোরে কুতর্কে নামবে।
খুব আফসোস হলো; সমরবাবুর সঙ্গে আমার সংক্ষিপ্ত এই আলাপটুকু ভালো একটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকতে পারতো। কিন্তু সৎকর্মকে উৎসাহিত করতে তার প্রচেষ্টা দেখে যতোটা খুশি হয়েছিলাম, পুরোটাই ভুলে গিয়ে মনটা বিমর্ষ হলো তার নারীবিদ্বেষ দেখে।
গত কদিন ধরে একটা কোর্সের ক্লাসে জেন্ডার কমিউনিকেশন পড়াচ্ছি। সুযোগ থাকলে তাকে ওই ক্লাসে আসতে বলতাম। কিন্তু উপায় নেই; যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তা কেবল নারী শিক্ষার্থীদের জন্য। এ ছাড়া, এই মানসিকতার লোকেদের এমন আকস্মিক আলাপে কিছু বলে-কয়ে খুব যে লাভ হয়, তা নয়। এমন মানসিকতার বহু লোকের সঙ্গে এসব নিয়ে তর্ক করেছি : অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষার্থী-শিক্ষক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানী-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-তথাকথিত ধর্মগুরু...। দেখেছি, যুক্তির জোরে জেতার চেয়ে জোরের যুক্তিতে অর্থাৎ পারলে একরকম গায়ের জোরে জিততে চায় তারা; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা তর্ক আর কুতর্কের মধ্যে পার্থক্য মানতেও নারাজ।
যারা ঠিক এই মানসিকতার মানুষ, তারা নিজেদের বিশ্বাস থেকে সরতে চান না। তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন, পুরুষরা 'ধোয়া তুলসিপাতা' আর নারীরাই যতো অনিষ্টের মূল। কতো সহজ-স্বাভাবিকভাবে এরা সব নারীকে নির্বিচারে 'নষ্টা' বলে দিতে পারে! অথচ নারীদের ছাড়া এদের জীবন চলে না! নারী না হলে এদের খাওয়া-ধোয়ার ব্যবস্থা হয় না। নারী ছাড়া এদের সেবা-শুশ্রুষা হয় না। নারী না থাকলে ঘরে ফিরে এদের চা খাওয়া হয় না। নারী ছাড়া এদের সংসার হয় না। নারী না থাকলে এদের সন্তান হয় না এবং সন্তানদের লালন-পালনের ব্যবস্থা হয় না। নারী না থাকলে এদের বৃদ্ধ বাপ-মায়ের সেবা-যত্ন হয় না। নারী না হলে এদের আত্মীয়-পরিজনদের দাওয়াত খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয় না। নারী না হলে এদের জন্মই তো হয় না! এরপরও, এদের বিবেচনায় নারীই সব অনিষ্টের গোড়া; নারীরা সাক্ষাৎ শয়তানের ধারক-বাহক।
ভাবলাম, এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে জেন্ডার বিষয়ক জ্ঞান দিতে গিয়ে কুতর্কেই জড়ানো হবে কেবল। আর, সব দোষ কেবল এই একেকজন সমরের তো নয়। পরিবার আমাদের কী শেখায়? বাবা-মায়েরা সন্তানদের কী শেখান? বিদ্যাপীঠ, সমাজ, সংস্কৃতি আমাদের কী শেখায়? ধর্মগুরুরা তাদের ভক্ত-অনুসারীদের কী শেখান?
ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে; এই ব্যক্তির সঙ্গে কুতর্কে জড়ানোর চেয়ে ঠিক সময়ে ক্লাস শুরু করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বারবার বিদায় নিচ্ছি, কিন্তু তিনি তখনও বলে যাচ্ছেন-
- 'সজীবদা, স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন। ঠিক সময়ে খাবেন। সৎ থাকবেন। বাকি সব ভগবান দেখবেন। চিন্তা করবেন না; বাবা (ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র) বলেছেন...।'
'সমর' চরিত্রটি আমাদের চারপাশে নানা নামে, নানা পরিচয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যও নানারকম। তারা মাঝে-মধ্যে দু-চারটা ভালো কথাও বলেন বটে, তবে তাদের মনের এই অন্ধকার, মজ্জাগত নারীবিদ্বেষ আর মনের সঙ্কীর্ণতা দূর করা বড় কঠিন কাজ। দীর্ঘ, বড় দীর্ঘ এ সাধনা!
আমাদের সবার মনের অন্ধকার দূর হোক; অমাবশ্যার অন্ধকারের চেয়ে মনের অন্ধকার বেশি বিপজ্জনক। আমাদের সবার মনের ময়লা কাটুক; সড়কে পড়ে থাকা আবর্জনার চেয়ে মনের আবর্জনা বেশি ক্ষতিকর।
সবাই মিলে মানুষ হই। সমাজটা মানুষের হোক।
সজীব সরকার : চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।