কুকুর কিংবা খাসি নয়, গল্পটা অবিশ্বাসের
সজীব সরকার
প্রকাশিত: ০০:০৬, ২৮ মার্চ ২০২৩; আপডেট: ০০:০৯, ২৮ মার্চ ২০২৩
ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে খাদ্য প্রস্তুতকরণ এবং তা পরিবেশন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। ছবি : সংগৃহীত।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় কাচ্চি বিরিয়ানিতে খাসির বদলে কুকুরের মাংস দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সাড়া ফেলে। এরপর আনুষ্ঠানিক তদন্ত হয়। সরকারি তদন্তের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, খাসির মাংসের বদলে অন্য প্রাণির মাংস দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি।
কথা হলো, সন্দেহ হলে ভোক্তা অভিযোগ তুলতেই পারেন। তবে, সেটি যথাস্থানে; যেমন- জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বরাবর। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া 'কুকুরের মাংস দিয়েছে' বলে প্রচার করলে ব্যবসায়ীর ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। এমনটা করা অবশ্যই অনুচিত।
অনেকে কেবল ওই 'শোনা অভিযোগের' ভিত্তিতেই এ নিয়ে হাজারো মন্তব্য-কুৎসা করেছেন। ওই যে, 'দুই বিঘা জমি' কবিতার মতোই : 'বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।' এটিও অনুচিত হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু, এরপরও একটি কথা এখানে ভেবে দেখার দরকার রয়েছে : 'বিটুইন দ্য লাইনস' কী এখানে? উত্তর হলো : ভোক্তাদের অবিশ্বাস।
বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের মান নিয়ে ভোক্তাদের অসন্তোষ এবং অবিশ্বাস যে চরম আকারে বিদ্যমান, এ ধরনের ঘটনায় সবার আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার ঘটনাই এর একটি প্রমাণ।
আমরা যা খাচ্ছি, এর মান নিয়ে সন্তুষ্ট নই। ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে খাদ্য প্রস্তুতকরণ এবং তা পরিবেশন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত। খাসি বলে কুকুর-বেড়াল-শেয়াল কিংবা গরু বলে মরা-পঁচা মহিষের মাংস দেওয়ার অনেকগুলো ঘটনাই তো প্রমাণিত। খামারে অসুখ-বিসুখে বা অন্য কারণে মরে যাওয়া মুরগিগুলো যে রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো জেনে-বুঝেই খাওয়াচ্ছে, এ কথা তো মিথ্যা নয়। নামি-দামি রেস্তোরাঁ বা ক্যাফেতে নিম্নমানের ও বিষাক্ত রাসায়নিক যে ফুড কালার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা তো বহুবার হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। গরুর দুধ বলে কীসব খাওয়ানো হয়, সে-ও আমাদের জানা। একবার গণমাধ্যমের খবরে দেখা গেছে, চটপটি ও ফুচকার সঙ্গে দেওয়ার টকে টয়লেট পরিষ্কারের হারপিকও ব্যবহার করে কেউ কেউ। আর নোংরা রান্নাঘর, বহুদিনের পোড়া-বাসি তেলে খাবার রান্না, পঁচা-বাসি খাবার পরিবেশন কিংবা পরিবেশিত খাবারে তেলাপোকা বা মাছি থাকার ঘটনা তো চোখের সামনেই দেখতে পাই আমরা।
বিলাসবহুল সুপারশপগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, মানহীন পণ্য বিক্রি এবং ভুয়া প্রাইজ ট্যাগ লাগিয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রির ঘটনা প্রমাণিত। হাতে-নাতে ধরা পড়ে অনেকে জরিমানা দিয়েছে; এতেই তো এসব অনিয়মের প্রমাণ মেলে। মেয়াদোত্তীর্ণ বা নকল ওষুধ বিক্রির দায়ে পথের ধারের ফার্মেসি শুধু নয়, জরিমানা গুণেছে নামি-দামি হাসপাতালের ভেতরে তাদের নিজস্ব ফার্মেসিও। এমনকি করোনা মহামারীর সময়ও দেখা গেছে, ব্যবহারের পর ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া সিরিঞ্জ বা ইনজেকশনের সুঁই ও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী বার বার ওষুধের দোকানে বিক্রি হয়েছে। স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশকের নামে রং দেওয়া পানি বোতলে ভরে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বলে কাঠ ঘষার (বার্নিশ) রাসায়নিক বিক্রি হয় এ দেশে।
'ফলের জুস' নাম দিয়ে ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল বিক্রি; মাছ-শাক-সবজিতে ক্ষতিকর ওষুধ বা কীটনাশক; পোল্ট্রি ফিড তৈরিতে ট্যানারির বর্জ্যসহ ক্ষতিকর নানা ধরনের আবর্জনা ও রাসায়নিক ব্যবহার; ফল পাকাতে ও পরিবহনকালে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার; সরকার থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও একই চালকে নানাভাবে ছাঁটাই করে বিভিন্ন নামে ও বেশি দামে বিক্রি; রাসায়নিক প্রয়োগ করে ফার্মের ডিমের খোসাকে সাদা বানিয়ে 'দেশি' ডিম বলে বিক্রি; মশলা বলে ইট-কাঠ-মাটির গুঁড়া বিক্রি; চকের গুঁড়া বা কস্টিক সোডার মতো ক্ষতিকর পদার্থ পানিতে গুলে দুধ বলে বিক্রি; জুতার আঠা বা ফেভিকল জ্বাল দিয়ে ঘি বলে বিক্রি - কোন জিনিসটি আমাদের এখানে হচ্ছে না?
তাহলে কথা হলো, এ ধরনের একটা অভিযোগ উঠলে যে ভোক্তারা সেটা প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই 'ঘটনা সত্য' বলে মেনে নিয়ে বিষোদগার শুরু করেন, এজন্য কিন্তু খাদ্যপণ্যের সাথে সম্পৃক্ত খামারি-চাষি-ব্যবসায়ীদের নির্মম অসততাই মূলত দায়ী।
বিশেষ একটি ঘটনা সত্য বা মিথ্যা - তা প্রমাণের দাবি রাখে নিশ্চয়ই। কিন্তু, এই যে এ ধরনের একটা কথা উঠলেই সবাই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেন - এই পরিস্থিতি কিন্তু বাংলাদেশে তৈরি হয়ে গেছে। আর এমনটি একদিনে ঘটেনি; দীর্ঘদিনের অসাধুতায় এটি তৈরি হয়েছে। এখানে কোন অভিযোগ সত্য আর কোনটি মিথ্যা- তা প্রমাণ হওয়া পর্যন্ত ভোক্তারা যে মন্তব্য-নিন্দা না করে বসে থাকবে, এই আশা বাড়াবাড়ি।
তাই, এবারের ঘটনায় কে সত্য কে মিথ্যা অথবা প্রমাণ ছাড়া লোকে কেন কী বললো, এদিকে নজর দেওয়ার চেয়ে এই অবিশ্বাস যে কারণে তৈরি হয়েছে ভোক্তাদের মধ্যে, সেটির মেরামত বেশি জরুরি।
যারা সততার সঙ্গে কাজ করছেন, তাদের স্যালুট। যারা অসৎ এবং ভোক্তাদের ক্ষতি করছেন, তাদের জন্য সতর্কবার্তা : আপনারাও কখনো সখনো 'ভোক্তা'।
এর চেয়ে বেশি কিছু বলবার বোধ করি প্রয়োজন নেই!
সজীব সরকার : চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।