ট্রাম্পকে পাল্টা জবাব
শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের
অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১২:৪৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ট্রাম্প আমদানির ওপর চীনের ক্ষেত্রে ১০% এবং কানাডা ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে ২৫% শুল্ক বাড়িয়েছেন।
বৈদেশিক বাণিজ্যে শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গতকাল শনিবার সরকারি আদেশে স্বাক্ষর করে সে ঘোষণা বাস্তবায়ন করলেন তিনি। বৈদেশিক বাণিজ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধু কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের পণ্যে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি দেশগুলো। ফলে, তারাও একইভাবে শুল্ক বাড়ানোর পাল্টা ঘোষণা দিয়েছে।
রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলেন, 'আমেরিকানদের রক্ষার জন্য' শুল্ক বাড়ানো জরুরি।
এর পাশাপাশি তিনি এ তিন দেশকে অবৈধ ফেনটানিলের উৎপাদন ও যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ কমাতে বলেন। একইসঙ্গে, কানাডা ও মেক্সিকোকে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন কমাতেও বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, বর্ধিত শুল্ক হার মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে।
অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ট্রাম্প আমদানির ওপর চীনের ক্ষেত্রে ১০% এবং কানাডা ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে ২৫% শুল্ক বাড়িয়েছেন। কানাডা থেকে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ শক্তি আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর ধার্য হবে।
এ পরিস্থিতিতে বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহত্তর অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে, এখন মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে এর দায় কেবল ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তের বলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে প্রধান বিরোধী ডেমোক্র্যাট দল।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা উইলিয়াম রাইনশ মন্তব্য করেছেন, অর্থনীতির বিবেচনায় এটি (শুল্ক বাড়ানো) ভালো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিনি বলেছেন, 'ঐতিহাসিকভাবেই কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক কম ছিলো। কারণ, এতে কোম্পানিগুলো সস্তায় কাঁচামাল এনে কম খরচে পণ্য উৎপাদন করতে পারে... কিন্তু, তিনি (ট্রাম্প) এখন কী বলছেন? তিনি কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর কথা বলছেন। এটা কেমন অর্থনীতি হলো, আমি বুঝতে পারছি না।'
অনেকে মনে করছেন, শুল্ক বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত বজায় থাকলে মূল্যস্থীতির হার বেড়ে অনেক খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জ্বালানি, আবাসন ও গাড়িসহ নানা পণ্যের খরচ কমানোর যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প, সেটিও ব্যর্থ হবে। উল্টো বরং এসব পণ্যের দাম আরো অনেক বাড়বে। সার্বিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এ সিদ্ধান্ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলারও আশঙ্কা রয়েছে।
শনিবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, 'হোয়াইট হাউজের নেওয়া এ পদক্ষেপ আমাদের কাছে আনার বদলে বরং পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।'
তিনি জানান, এর পরিপ্রেক্ষিতে তার দেশও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা অ্যালকোহল ও ফলসহ অন্যান্য পণ্যের মোট প্রায় ১৫৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বাণিজ্যের ওপর একই হারে (২৫%) শুল্ক আরোপ করবে।
ট্রুডো দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণে কানাডার বাসিন্দারা প্রতারিত বোধ করছে। এ সময় তিনি মনে করিয়ে দেন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাথে কানাডার বাহিনীও লড়াই করেছিলো। এ ছাড়াও, ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল কিংবা হারিকেন ক্যাটরিনার মতো দুর্যোগেও কানাডা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকেছি, আপনাদের - আমেরিকানদের দুঃখে দুঃখী হয়েছি।'
জানা গেছে, শুল্ক বাড়ানোর প্রতিবাদ হিসেবে কানাডার প্রদেশ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কেনায় বাসিন্দাদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সরকারি স্টোরগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অ্যালকোহলের বোতল শেলফ থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টও একইভাবে পাল্টা শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। মেক্সিকোর স্বার্থ রক্ষায় তিনি একইভাবে শুল্ক বাড়ানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে দেশটির অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম এক এক্স বার্তায় বলেছেন, 'হোয়াইট হাউজ যে অপরাধী সংগঠনগুলোর সঙ্গে মেক্সিকোর সরকারের সম্পর্ক থাকার অভিযোগ তুলেছে, আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি।'
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র যদি ফেনটানিলের ব্যবহার কমাতে চায়, তাহলে তাদের উচিৎ নিজ দেশের পথে-ঘাটে এর কেনা-বেচা নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু, তারা এটা করে না।'
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটির সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের কঠোর প্রতিবাদ করছে। এ ছাড়া, নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষাও তারাও পাল্টা পদক্ষেপ নেবে।
মেক্সিকোর মতো চীনও অভিযোগ করে বলেছে, ফেনটানিলের মতো ওষুধের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে নীতিগতভাবে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু, দেশের অভ্যন্তরে এর অপব্যবহার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
শুল্ক বাড়ানোর নির্দেশ জারির মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পের জোরালো অবস্থান স্পষ্ট হলো। কিন্তু, ট্রাম্প সমর্থকদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, শুল্ক বাড়ানোর এ ঘটনা মূলত দেশগুলোকে ট্রাম্পের চাপে ফেলার একটি কৌশল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ল্যাব দেশটির অর্থনীতিতে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের ক্ষতিকর প্রভাবের সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করেছে। তারা দেখিয়েছে, পরিবারগুলো এখন ট্যাক্স থেকে তাদের প্রায় ১ হাজার ১৭০ ডলারের সমপরিমাণ আয় হারাবে।
একইসঙ্গে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমবে এবং মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আর, অন্য দেশগুলো যদি পাল্টা শোধ নিতে একইরকম সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সার্বিকভাবে পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ হয়ে যাবে।
তবে, এতে থেমে না থেকে শুল্ক বাড়ানোর আওতা আরও বড় করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ট্রাম্প। গত শুক্রবার তিনি উল্লেখ করেন, কম্পিউটার চিপ, ইস্পাত, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, তামা ও ওষুধ এবং ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে আমদানির ওপর কর আরোপ করা হবে।
তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি খাদে পড়ে যাবে।
বাড়তি করের বোঝার চাপ কমাতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দেশটির নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের বদলে নিজ দেশের পণ্য কেনার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে, তিনি এমন আশাবাদও জানিয়েছেন যে দীর্ঘদিনের বন্ধু দেশটির সঙ্গে এ অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হবে না; বরং এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
সূত্র : এপি।